ইন্দিরার নির্দেশে ছেলের 'অশ্লীল' ছবি ফাঁস! বারবার কেন প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি দলিত জগজীবন রামকে?

Babu Jagjivan Ram: আমৃত্যু সাসারামের সাংসদ ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর কন্যা সাংসদ হন সাসারামের। ২০০৯ সালে লোকসভার স্পিকারও হন মীরা কুমার।

১৯২২ সাল। বিহারের আরাহ জেলার অন্যতম নামি স্কুল টাউন বয়েজ হাই স্কুল। সেই সময় এটি ছিল শহরের একমাত্র ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সেই স্কুলে প্রত্যেকটি ক্লাসঘরে রাখা থাকতো দু'টি জলের কুঁজো। হিন্দু জল এবং মুসলমান জল। শুনতে অবাক লাগলেও, আজও বহু বহু প্রান্তের স্কুলে 'নিচু' জাতের কেউ কুঁজো থেকে জল খেলে শাস্তি পেতে হয়। সেবার এক গ্রীষ্মের সকালে এক তৃষ্ণার্ত শিশু উচ্চবর্ণের হিন্দু জলের কুঁজো থেকে এক মগ জল খেতেই হইচই পড়ে যায় স্কুলে। স্রেফ শিশুটি দলিত বলে। স্কুলে অশান্তির পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে ভেবে প্রধান শিক্ষক পরদিন থেকে তিনটি কুঁজোর ব্যবস্থা করেন - হিন্দু জল, মুসলমান জল এবং দলিত জল। সেই ছেলেটি তৃতীয় কুঁজোটি দেখে ক্ষুব্ধ হয় এবং ভেঙে দেয়। প্রধান শিক্ষক আরেকটি দলিত কুঁজো বসান ক্লাসে, সেটিও ভেঙে দেয় ছেলেটি। এবার প্রধান শিক্ষকের বোধোদয় হয়, তিনি আর কোনও দলিত কুঁজো বসাননি।

এই বিদ্রোহী স্বভাবের শিশুই পরবর্তীকালে গিয়ে হয় দলিতদের সবচেয়ে বড় নেতা। অনেকেই বলেন, এই নেতা আসলে ছিলেন আম্বেদকরের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় দলিত মুখ। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসে এবং প্রতিবারই চক্রান্ত করে তাঁর থেকে সেই সুযোগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তিনি বাবু জগজীবন রাম। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরুর অন্তরীণ ক্যাবিনেটের সদস্য হয়েছিলেন। সেই থেকে আমৃত্যু, টানা ৪০ বছর সাংসদ ছিলেন তিনি। এই রেকর্ড আজও ভাঙতে পারেনি কেউ। ৪ দশকের সংসদীয় রাজনীতি ছাড়াও ৩০ বছরের বেশি সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা, কৃষি, সূচনা এবং সম্প্রসারণ-সহ বিভিন্ন মন্ত্রক সামলেছেন। হয়েছেন উপ-প্রধানমন্ত্রীও। তবে তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম দৈনিক বেতন, বোনাস, বিমা-সহ একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি।

টাউন স্কুলে পড়াকালীনই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালব্যের সংস্পর্শে আসেন বাবু জগজীবন রাম। ১৯২৫ বা ১৯২৬ সাল নাগাদ টাউন স্কুলে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মালব্য। সেই অনুষ্ঠানে জগজীবন রামের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। অনুষ্ঠানের পরেই জগজীবনকে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে এসে পরবর্তী পড়াশোনা করার অনুরোধ করেন তিনি। ১৯২৬ সালে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পা রাখেন বাবু জগজীবন রাম। মদনমোহন মালব্য তাঁকে সাদরে স্বাগত জানালেও ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা তাঁকে মেনে নিতে পারেনি। ছাত্রদের মেসে একসঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার ছিল না তাঁর। তাঁর চুল-নখ কাটতে চাইত না বেনারসের নাপিতরা, বাধ্য হয়ে সুদূর হাজিপুর থেকে আনাতে হতো নাপিত। অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন জগজীবন। ১৯২৮ সালে বেনারস ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন তিনি। ১৯৩১ সালে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিহারে ফিরে যান বাবু জগজীবন রাম, সেখানেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বাবু জগজীবন রাম, ১৯৪৯

১৯৩৫ সালে বাবু জগজীবন রাম নিজের রাজনৈতিক দল 'অল ইন্ডিয়া ডিপ্রেসড ক্লাস পার্টি' গড়ে তোলেন। ১৯৩৬ সালে বিহারে বিধান মণ্ডলের ভোটে কংগ্রেসের সমর্থনে তিনি লড়েন এবং জেতেন। ১৯৩৭ সালে জওহরলাল নেহরু এবং বল্লভভাই প্যাটেলের পরামর্শে নিজের পার্টির কংগ্রেসে বিলয় করিয়ে দেন। কংগ্রেস প্রথম থেকেই জগজীবন রামের মতো একজন নেতাকে লুফে নিতে চেয়েছিল। আম্বেদকরের মতো একজন নেতার সমান্তরালে দলিতদের জন্য কাজ করে গিয়েছেন বাবু জগজীবন রাম। কীভাবে ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে সমাজ সংস্কার করা যায় তা শেখা উচিত তাঁর থেকে। স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের সবচেয়ে কম বয়সি মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬২, এই ১৫ বছর উল্কার গতিতে উত্থান হয় তাঁর। কিন্তু প্রথম তাল কাটে ১৯৬৩ সালে। এর কামরাজ প্ল্যান বিষয়ক একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উল্লিখিত আছে, কীভাবে এই প্ল্যানের কারণে ইস্তফা দিয়েছিলেন ৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আসলে সংখ্যাটা ৬ নয়, ৭ হওয়ার কথা ছিল। অন্যান্যরা ইস্তফা দিতে রাজি হলেও দিতে চাননি জগজীবন রাম। ফলস্বরূপ তাঁকে ক্যাবিনেট থেকে 'ড্রপ' করে দেন নেহরু। পরবর্তীকালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ক্যাবিনেটেও জায়গা হয়নি তাঁর।

আরও পড়ুন- ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, ইন্দিরার হাতেই শেষও হয়ে যান! কে ছিলেন কামরাজ?

১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পুনরায় নিজের মন্ত্রিত্ব ফিরে পান জগজীবন রাম। ইন্দিরা তাঁকে শ্রমমন্ত্রীর পদ দেন নিজের ক্যাবিনেটে। ১৯৬৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে ক্যাবিনেট বিস্তারের সময় কৃষিমন্ত্রকের দায়িত্বও দেওয়া হয় জগজীবনকে। তাঁর আমলেই ভারতে সবুজ বিপ্লব হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে কংগ্রেসে আড়াআড়ি দু'টি ভাগ হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বপ্রথম বাবু জগজীবন রামের নাম প্রস্তাব করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। কিন্তু উচ্চবর্গীয় কংগ্রেস 'ওল্ড গার্ড'-রা সরাসরি নাকচ করে দেন এবং নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে ইন্দিরার 'অন্তরাত্মার আওয়াজে' হেরে যান রেড্ডি। নীলম সঞ্জীব রেড্ডি যেন হেরে যান তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন বাবু জগজীবন রাম। এই ঘটনার কথা কানে যেতেই বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রেড্ডি, পরবর্তীকালে এর প্রতিশোধও নিয়েছিলেন। সে কথায় পরে আসছি।

ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনারত বাবু জগজীবন রাম

১৯৭১ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্ব দেওয়া হয় ইন্দিরা গান্ধি ও স্যাম মানেকশ-কে। উপেক্ষিত থেকে যান জগজীবন। ১৯৭৩ সাল থেকেই কংগ্রেসের অন্দরে ক্রমশ ক্ষমতার রাশ নিজের হাতে নিতে শুরু করেন সঞ্জয় গান্ধি। ইতিমধ্যেই ১৯৭১ সালের নির্বাচনে সরকারি মেশিনারি ব্যবহার করেছেন ইন্দিরা গান্ধি, এই অভিযোগে পিটিশন দায়ের হয়। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এই মামলায় রায়দান করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। জাস্টিস সিনহার বেঞ্চ ছয় বছরের জন্য নির্বাচন এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে 'ব্যান' করে ইন্দিরাকে। দলের অন্দরে অনেকেই ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি খালি করে দেবেন ইন্দিরা। দলের একটা বড় অংশ এবং বাবু জগজীবন রাম নিজেও মনে করতেন, ইন্দিরা তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী করবেন। সেই সময় ইন্দিরার ক্যাবিনেটের সবচেয়ে অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন তিনি কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি। ২৫ জুন এমার্জেন্সি ঘোষণা করেন ইন্দিরা গান্ধি এবং দেশে শুরু হয় গণতন্ত্রের এক কালো অধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে অনেকে দল ছেড়ে চলে গেলেও ছেড়ে যাননি বাবু জগজীবন রাম। তিনি অপেক্ষা করছিলেন উপযুক্ত সময়ের।

সময় এল ১৯৭৭ সালে। ১৯৭৭ সালের ২৩ জানুয়ারি এমার্জেন্সি তুলে দেওয়া হয় এবং ঘোষিত হয় লোকসভা নির্বাচন। সেই সময় পর্যন্ত নিজের জয় নিয়ে একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন ইন্দিরা। জনতা পার্টির তাবড় তাবড় নেতারাও ধরে নিয়েছিলেন তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু খেলা ঘুরে যায় ১২ ফেব্রুয়ারি। ইন্দিরা ক্যাবিনেটের সবচেয়ে অভিজ্ঞ মন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম ঘোষণা করেন তিনি কংগ্রেস ছাড়ছেন এবং জনতা পার্টির টিকিটে নির্বাচন লড়বেন। জগজীবন রামের এই ঘোষণার সঙ্গেই গোটা দেশের দলিত ভোট ব্যাঙ্ক জনতা পার্টির খাতায় চলে আসে। উজ্জীবিত হন জনতা পার্টির নেতারা, নতুন উদ্যমে প্রচার শুরু করেন তারা। এই আবহেই আয়োজিত হয় বিহারের রামলীলা ময়দানের সেই ঐতিহাসিক জনসভা। সেই সভায় বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবানী, চন্দ্রশেখর, বাবু জগজীবন রাম প্রমুখের। জনসভার ভিড় ম্লান করতে তৎকালীন সূচনা এবং সম্প্রচার মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লর নির্দেশে দূরদর্শনে প্রিমিয়ার করা হয় 'ববি'-র। ঋষি কাপুর এবং ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত এই ছবি সেই সময়কার অন্যতম ব্লকবাস্টার ছিল। কিন্তু ববি দেখিয়েও ভিড় কমানো যায়নি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও বাবু জগজীবন রামের ভাষণ শুনতে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল রামলীলা ময়দানে। পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল 'Babu Beats Bobby'।

আরও পড়ুন- মায়াবতীর বিশ্বাসঘাতকতায় পড়ে যায় সরকার, যে অভাবনীয় প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বাজপেয়ী…

রামলীলা ময়দানের জনসভায় জগজীবন রাম

বাবু জগজীবন রামের জনপ্রিয়তা দেখে অনেকেই আশা করেছিলেন জনতা পার্টির সরকার তৈরি হলে ভারত নিজের প্রথম দলিত প্রধানমন্ত্রী পাবে। ২৩ মার্চ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পেতেই স্পষ্ট হয়ে যায় সরকার গড়তে চলেছে জনতা পার্টি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? এই নিয়ে দলের অন্দরে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। মোরারজি দেশাই সাফ জানিয়ে দেন তিনি কুর্সি ছাড়বেন না। চৌধুরী চরণ সিং এবং বাবু জগজীবন রামও অনড় ছিলেন। দলীয় দ্বন্দ্ব মেটাতে হস্তক্ষেপ করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। চৌধুরী চরণ সিং উপ-প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হন। কিন্তু বেঁকে বসেন জগজীবন রাম। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব না পেলে কোনওমতেই ক্যাবিনেটে সামিল হবেন না। এর মাঝে একদিন বাবু জগজীবন রামকে একান্ত সাক্ষাতে ডাকেন জেপি। শোনা যায়, এই সাক্ষাতে জগজীবন রামের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন তিনি। নিজের রাজনৈতিক গুরুর এই দশা দেখতে পারেননি জগজীবন রাম। না চাইতেও, শুধুমাত্র জয়প্রকাশ নারায়ণের কথায় উপপ্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করেন তিনি।

এর মধ্যেই ঘটে যায় বেলচি হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৭ সালের ২৭ মে রাত এগারোটা নাগাদ বিহারের বেলচি গ্রামে ১৫ জন দলিতকে হত্যা করে কিছু উচ্চবর্গীয় জমিদার। ঘটনার কথা আগুনের মতো ছড়িয়ে যায় দেশজুড়ে। সেই সময় বিহারে জনতা পার্টির সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর। তাঁর সরকারে কীভাবে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে দেশের সর্বত্র। ঘটনার পর নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চেয়েছিলেন বাবু জগজীবন রাম কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আপত্তিতে তা পারেননি। তবে বিরোধী নেত্রী ইন্দিরা গান্ধি বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেননি। রাস্তা খারাপ হওয়ায় হাতির পিঠে চেপেই বেলচি গ্রামে যান ইন্দিরা, দেখা করেন নিহতদের পরিবারের সঙ্গে। যে দলিত ভোটের উপর ভিত্তি করে জনতা পার্টি সরকার গড়েছিল, সেই দলিতরাই ক্রমশ ইন্দিরার দিকে যেতে শুরু করে। আড়াই বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি দেশাই। দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে পতন অবধারিত ছিল জনতা সরকারের। মোরারজির পর প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী চরণ সিং। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন বাবু জগজীবন রাম নয়? কারণ জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে।

হাতির পিঠে ইন্দিরা গান্ধি, ১৯৭৭

জগজীবন রাম তখন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যতম শক্তিশালী নেতা। সেই সময়কার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল সূর্য। এই পত্রিকার এক সংখ্যায় জগজীবন রামের পুত্র সুরেশ কুমারের কিছু আপত্তিজনক ছবি বেরোয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছিলেন তিনি। সেই সময় তোলা হয়ে ছবিগুলি, কে তুলেছিল তা জানা যায়নি। সুরেশ কুমারের বয়স তখন ৪৬ এবং ছাত্রীটির বয়স মাত্র ২১। স্বাভাবিকভাবেই দেশ তোলপাড় হয়ে যায় এবং নিজের রাজনৈতিক পুঁজি হারিয়ে ফেলেন জগজীবন রাম। সুরেশ কুমার প্রথমে এই ঘটনার কথা অস্বীকার করলেও পরবর্তীকালে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। সুরেশের কন্যা কীর্তি সেই সময় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বাবার 'কুকীর্তির' ঠেলায় কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয় সে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ছবিগুলি প্রকাশ করালো কে? সূর্য পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন ইন্দিরা গান্ধির পুত্রবধূ মেনকা গান্ধি। ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশেই ছবিগুলি প্রকাশ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ১৯৭৭ সালে করা বিদ্রোহের খেসারত দিতে হয়েছিল জগজীবন রামকে। সেই সময় সূর্য পত্রিকার কনসাল্টিং এডিটর ছিলেন খুশবন্ত সিং। তিনি রাজি ছিলেন না ছবিগুলি প্রকাশ করতে। তাঁর ভাষায়, 'Those were nothing but porn'।

এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড় থেকে অনেকটাই পিছিয়ে যান জগজীবন। রাজনৈতিক পতন শুরু হয় তাঁর। তবে জীবনে শেষবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসে ১৯৮০ সালে। ততদিনে জনতা পার্টি ভেঙে গেছে এবং চৌধুরী চরণ সিং সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। শেষ মুহূর্তে চরণ সিংয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ইন্দিরা গান্ধি। তবে জনতা পার্টি ভেঙে গেলেও সব সাংসদরা একত্রিত হয়েছিলেন জগজীবন রামকে প্রধানমন্ত্রী করার দাবিতে। অন্য কোনও নেতার নেতৃত্বে নয়, শুধুমাত্র জগজীবন রামের নেতৃত্বে যদি সরকার গঠিত হয় তাহলেই তাঁরা সরকারে থাকবেন, এমন দাবি করেন জনতা পার্টির সাংসদরা। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল বাবু জগজীবন রামকে সরকার গড়ার জন্য আমন্ত্রণ করা কিন্তু রাষ্ট্রপতি তা করলেন না। ১৯৮০ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। তাঁর মনে জগজীবন রামের প্রতি আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল। ১১ বছর আগে তাঁর কারণেই রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি রেড্ডি। এবার পালা প্রতিশোধের। সংবিধানের তোয়াক্কা না করে লোকসভা ভঙ্গ করার নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি। দেশে ফের লোকসভা নির্বাচন হয় এবং বিপুল ভোটে জিতে আসেন ইন্দিরা গান্ধি।

ইন্দিরা জিতে আসতেই জগজীবন রামের রাজনৈতিক জীবনে অঙ্কুশ পড়ে যায়। ১৯৮১ সালে অবশ্য কংগ্রেস জগজীবন নামে একটি দল গড়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা মীরা কুমার সেই পার্টির বিলয় করিয়ে দেন কংগ্রেসে। আমৃত্যু সাসারামের সাংসদ ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। তাঁর মৃত্যুর পর, ২০০৪ সালে তাঁর কন্যা সাংসদ হন সাসারামের। ২০০৯ সালে লোকসভার স্পিকারও হন মীরা কুমার। বাবু জগজীবন রামের কাহিনি আসলে এমন এক নেতার কাহিনি যিনি নিজের যোগ্যতা বার বার প্রমাণ করা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য থেকে। শোনা যায়, বিদেশি সিগারেটের বড় ভক্ত ছিলেন তিনি কিন্তু সিগারেট খাওয়ার ধরন ছিল একটু আলাদা। গ্রামে কৃষক কিংবা শ্রমিকরা যেভাবে বিড়ি খান দু'হাত মুঠো করে, জগজীবন রাম সেইভাবেই সিগারেট খেতেন। সেই সময়কার অনেক সাংবাদিকই লিখেছেন, 'He smokes like a peasant'। আসলে ক্ষমতার শিখরে উঠেও কখনও নিজের শিক্ষাকে, সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি জগজীবন রাম।

 

More Articles