এক শুনানিতে চাকরি বাতিল ২৬ হাজারের, নেপথ্যে কি সেই অভিজিৎ?

West Bengal SSC Recruitment Case: কলকাতা হাইকোর্টের এসএসসি রায়ে চাকরি খোয়ালেন ২৬ হাজার শিক্ষক। হাইকোর্টের সোমবারের রায় বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে অভিজিৎবাবুর একের পর এক নির্দেশের কথা।

এসএসসি দুর্নীতি মামলায় বিরাট সিদ্ধান্ত শোনাল হাইকোর্ট। বাতিল হল প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ। শুধু যে চাকরি গেল, তা-ই নয়। তাঁদের ফিরিয়ে দিতে হবে বেতনও, এবং তা-ও সুদ-সমেত। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের মুখে হাইকোর্টের এমন রায়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে এ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার কাঁটা দীর্ঘদিন ধরেই গলায় বিঁধে রয়েছে তৃণমূলের। আর ভোটের মধ্যে সেই কাঁটা যেন আরও বিপদ বাড়ালো রাজ্যসরকার। এর আগে একাধিক বার কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের মসিহা অভিজিৎবাবু যে বিচারপতির চেয়ারে বসে খুব ভুল কথা বলেননি, সে কথাই ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছে সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের এসএসসি-রায়।

দীর্ঘদিন ধরেই এ রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ। শুধু এসএসসি নয়, প্রাইমারির শিক্ষক নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে নালিশ। এর আগে একগুচ্ছ প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল হাইকোর্টে। সেই নিয়ে এখনও মামলা চলছে। এবার ২৫ হাজার ৭৫৩ জন এসএসসি শিক্ষকের চাকরি গেল হাইকোর্টের নির্দেশে। এই এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় এর আগে একাধিক নির্দেশ এসেছে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের তরফে। ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের মসিহা। সেই মসিহা এতদিনে বিচারপতির পদ ছেড়ে নেমে এসেছেন সংসদীয় রাজনীতিতে। যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। চলতি লোকসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে তমলুক থেকে প্রার্থীও হয়েছেন তিনি। সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের রায় বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে অভিজিৎবাবুর একের পর এক নির্দেশের কথা। বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার বাতিল করেছে ২০১৬ সালের গোটা প্যানেলই। প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক চাকরি হারালেন।

আরও পড়ুন: ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের মধ্যে রেহাই শুধু এক জনের! কীভাবে বাঁচলেন সোমা?

কলকাতা হাইকোর্টের এমন রায় প্রথম নয়। এর আগেও প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে গ্রুপ-সি কর্মীদের নিয়োগ বাতিল হয়। অভিজিৎ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর বারবার প্রশ্ন উঠেছে বিচারপতি থাকাকালীন অভিজিতের সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে। তবে প্রাক্তন বিচারপতির রায়ে যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের সাম্প্রতিক রায়েই। এ দিন এসএসসি মামলার রায় ঘোষণার সময়ই প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আইনজীবী সুদীপ্ত বসাক বলেন, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছিল যে তিনি প্রভাবিত হয়ে এই ধরনের রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে এটা স্পষ্ট, দুর্নীতি হয়েছিলই। পুরো প্যানেল বাতিল করা হল। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অনেক দয়ালু, তাই পুরো প্যানেল বাতিল করেননি।”Ex Justice Avijit Ganguly's Verdict In SSC Recruitment Scam Proven Right As Calcutta High Court Gives Verdict to Cancel Panel of 2016 & RecruitmentEx Justice Avijit Ganguly's Verdict In SSC Recruitment Scam Proven Right As Calcutta High Court Gives Verdict to Cancel Panel of 2016 & Recruitment

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যখন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন, সেই সময় ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি চলছিল তাঁর বেঞ্চে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সরাসরি যুক্ত হিসেবে উঠে এসেছিলল প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম। স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিযুক্ত ৯৫২ জন নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওএমআর শিট বিকৃত করে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। প্রথমে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চে মামলা উঠলেও, পরে মামলা হস্তান্তর হয়ে যায় বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর একক বেঞ্চে। বিচারপতি বসুর বেঞ্চ ৯৫২ জনের মধ্যে ৮০৫ জনের চাকরির সুপারিশপত্র বাতিল করে তাঁদের বরখাস্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয় এসএসসি-কে। উত্তরপত্রে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নেয় এসএসসি-ও। ৬১৮ জনের নাম প্রকাশ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার কথাও ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে আরও ১৫৭ জন নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক চাকরি হারান।

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ২৬৯ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। গত বছর সেপ্টেম্বরে মামলাটি ডিভিশন বেঞ্চে যায়। সেখানেও বহাল থাকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ই। অক্টোবর মাসে রাজ্য সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে সেই রায়ের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ০২২ সালের মে-জুন মাসে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে ৩৮১ জন গ্রুপ সি কর্মীর চাকরি বাতিল হয়। ৬০৯ জন গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি বাতিলেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পর ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে ১,৯১১ জন গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি যায়। চাকরি বাতিলের পাশাপাশি এই গ্রুপ ডি কর্মীদের বেতন ফেরত দেওয়ারও নির্দেশ দেন বিচারপতি।

Ex Justice Avijit Ganguly's Verdict In SSC Recruitment Scam Proven Right As Calcutta High Court Gives Verdict to Cancel Panel of 2016 & Recruitment

এবার সেই পথেই হাঁটল বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। এ দিনের রায় শোনার পর তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার অধিকার নেই। পাশাপাশি নাম না করেই মমতা-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের অন্যতম তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন তিনি। একই সঙ্গে দেশের বিচারব্যবস্থার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই অভিজিৎবাবু বলেন, কলকাতা হাইকোর্টের বেঞ্চ কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এতটা কাঠিন্য দেখাতে পারেননি, যা পেরেছে বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। তাঁদের সেই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, এসএসসি দুর্নীতি পুরোপুরি সামনে এলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভা নড়েচড়ে বসার আশঙ্কা। একই সঙ্গে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের জন্য মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করার কথাও জানিয়েছেন অভিজিৎবাবু।

আরও পড়ুন:ভোটের মুখে ২৬,০০০ চাকরি বাতিল! SSC-তে যোগ্য প্রার্থীরা আর কোনওদিন চাকরি পাবেন?

সোমবার হাইকোর্টের রায়ে শুধুমাত্র চাকরি বহাল রয়েছে বীরভূমের কন্যা সোমা দাসের। মারণ ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন সোমা। সেই অসুখ নিয়েই সুবিচারের আশায় আন্দোলনে নেমেছিলেন সোমা। মামলাকারীদের কাছ থেকে সোমার বিষয়ে শোনার পর তাঁকে চাকরি দেওয়ার জন্য রাজ্যসরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ। তাঁর সুপারিশেই চাকরি পান সোমা। ২০১৬ সালের প্যানেলে থাকা ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেলেও, একই স্কুলে বাংলা পড়াবেন সোমা। মানবিক কারণে এই সিদ্ধান্ত বলেই সোমবার জানিয়েছে হাইকোর্ট। সোমার চাকরির পিছনে হাত ছিল তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও।

লোকসভা ভোটের মুখে হাইকোর্টের এই রায় কতটা বিপাকে ফেলবে তৃণমূলকে, তা বলা শক্ত। তবে কলকাতা হাইকোর্টের এই বৈপ্লবিক রায় যে তমলুকের বিজেপি প্রার্থী তথা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঝুলিতে অতিরিক্ত কিছু ব্রাউনি পয়েন্ট যোগ করবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

More Articles