যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করবে না: ইমদাদুল হক মিলন

Imdadul Haq Milan Interview: মহৎ সাহিত্যিকরা যাই লেখেন, সেটা ছোটদের উপযোগী হোক বা যাই হোক, সেখানে খুব বড় একটা প্রতীক বা ইঙ্গিত থাকে। আমাদের ছোট নদী তেমনই এক কবিতা।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ- রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে এই অধ্যায় লেখা যায় না। আজও বাংলাদেশে নববর্ষকে বরণ করা হয় রবিরই গানে। কিন্তু বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ কি কোথাও পশ্চিমবাংলার রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা? সাহিত্যে ও গানে রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে উদযাপন করে বাংলাদেশ? সাহিত্যিক-সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় গৌতম রায়।


গৌতম- তোমার বেড়ে ওঠার সময়ে তো পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল নানা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। আয়ুব খান নিষিদ্ধ করছেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা দেখে অযৌক্তিকভাবে বলছেন, ‘মুসলমান কেন পারছে না রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লিখতে'। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরল। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা, মুসলিম জাতীয়তাবাদের কবরে পেরেক পুঁতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় বৈজয়ন্তী ওড়ানোর মতো প্রেরণা- সব যেন মিলেমিশে গেল সুফিয়া কামাল, শামসুর রহমান, করিম শরাফিদের নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথকে পাক-সামরিক জনতার হাত থেকে মুক্ত করবার লড়াইয়ে। এই সময়ের স্মৃতি মনে আছে? স্বাধীনতা লাভ থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশ, শেখ হাসিনার লড়াই- তোমার এই বেড়ে ওঠার সফর কেমন ছিল?

মিলন- তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যখন আয়ুব খান রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছেন, বাকিরা তখন রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধ করছেন। আমাদের ভাষা আন্দোলন শুরু হলো ভারতের স্বাধীনতার পরপরই। এরসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বড় যোগাযোগ আছে। রবীন্দ্রনাথই সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, বাংলাভাষার একজন কবি নোবেল সম্মান পেয়েছিলেন। এরপর দ্বিতীয় যিনি বাংলাভাষাকে এমন মর্যাদা দেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে তিনি বাংলায় ভাষণ দিলেন। এই দু'জন মানুষের কাছে বাঙালিরা আজীবন কৃতজ্ঞ। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। তখন অনেকেই প্রতিবাদ করেন এবং সেই সময়েও পয়লা বৈশাখের দিন রবীন্দ্রনাথের গান 'এসো হে বৈশাখ' গেয়েই বৈশাখ মাসকে বরণ করেছিলেন তারা। এই ঐতিহ্য আজও আছে, আরও ব্যাপকভাবে আছে। সারা দেশ যেভাবে নববর্ষকে বরণ করে সেখানে ধর্মের কোনও বিভেদ নেই। আর এর শুরুটা হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতটাই তো রবীন্দ্রনাথের লেখা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে জড়িয়ে, প্রতিদিনের যাপনের অঙ্গ। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, রবীন্দ্র সাহিত্য কি আর আগের মতো পাঠ করা হয়? আমার বিবেচনায়, রবীন্দ্রনাথের দু'খানা জায়গা অবিস্মরণীয়। তাঁর গান এবং তাঁর ছোটগল্প। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ছোটগল্প তাঁর হাতেই তৈরি। আর তাঁর গান! যে ২২৩৪ টি গান পাওয়া যায় সেগুলি অতুলনীয়। আমার জীবন শুরু হয় তাঁর গান দিয়ে।

গৌতম- ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্টের পর থেকে ১৯৯৬-এ নেত্রীর আবার ফিরে আসা, এই সময়কালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার ভার যাদের হাতে ছিল তারা কি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আয়ুব খানদের দৃষ্টান্তই অনুসরণ করেছিল?

মিলন- তারা সবসময়ই তাই করেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে, মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে তারা যে রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে গ্রহণ করবে না সেটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন- অক্তাবিও পাসের চোখে রবীন্দ্রনাথ: রেখা ও রঙের গায়ক

গৌতম- রবীন্দ্রনাথ তো দুই বঙ্গেরই। পূর্ব পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে একধরনের মানসিকতা কিছু মানুষের মধ্যে ছিল। কিন্তু আপামর বাঙালি, ধর্মপরিচয় ব্যাতিরেকে রবীন্দ্রনাথকে আপন করে নিয়েছিলেন। সেই রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে তোমার প্রথম পরিচয় কীভাবে?

মিলন- দেখো, রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ে যে বাঙালিরা জন্মেছেন, স্কুলে-কলেজে পড়েছেন, আমার ধারণা তাঁদের প্রত্যেকেরই পাঠ্যবই থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়। যেমন আমার পরিচয়, ১৯৬২ সালে। সম্ভবত আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমাদের পাঠ্যবইয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা শিশুতোষ কবিতা ছিল, "আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।" এই দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ সাহিত্যে। এই যে আমাদের ছোট নদী, আঁকেবাঁকে চলে, আমি বড় হওয়ার পর যখন রবীন্দ্রনাথ বিশদভাবে, বিস্তারিতভাবে পড়েছি তখন আমি এই কবিতাটা নিয়ে ভেবেছি। আমার জীবনের প্রথম কবিতা, পাঠ্যবইয়ে পড়া! কিন্তু আসলে কি এটা সত্যিই শিশুতোষ কবিতা? এর বক্তব্যটা কী? পরে ভেবে দেখেছি, এই ছোট নদীর আঁকেবাঁকে চলা, এর সঙ্গে মানব জীবনের একটা সম্পর্ক আছে। এই কথাটা বলার কারণ এটাই যে, মহৎ সাহিত্যিকরা যাই লেখেন, সেটা ছোটদের উপযোগী হোক বা যাই হোক, সেখানে খুব বড় একটা প্রতীক বা ইঙ্গিত থাকে। আমাদের ছোট নদী তেমনই এক কবিতা।

আরেকটি এমনই ছোট কবিতা আছে, নাম 'মোহ'। এই মোহ কবিতাটিতে আছে, "নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস..."

গৌতম- "ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস..."

মিলন- এটাও হয়তো ছোটদের উপযোগী করে তিনি লিখেছেন কিন্তু জীবনের অনেক বড় অর্থকে তা বোঝায়। এ তো গেল তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয়। এছাড়া তাঁর একটি গল্প আমাদের পাঠ্য ছিল। বলাই। বলাই গল্পটা একটা শিমূল গাছ আর একটা বাচ্চা ছেলের গল্প। বাচ্চাটা একটা শিমূল চারা উঠোনে এনে লাগায়, তার কাকা তা নিয়ে কথা শোনায়। বাচ্চাটিকে কলকাতা পাঠানো হয়। সে ফিরে এসে দেখে গাছটা নেই এবং সে খুব দুঃখ পায়। বাচ্চাটির কাকী তার সপক্ষে ছিলেন। তিনি অনেকবার কাকাকে বলেওছিলেন, বলাই গাছটা বুনেছে, তুমি ফেলে দিও না। তো যাই হোক। এখন আমরা প্রকৃতি নিয়ে এত কথা বলি। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একটি শিশু উপযোগী গল্পের মধ্যে দিয়ে একটা গাছের সঙ্গের শিশুর বন্ধুত্বের যে বীজটা বপন করে দিলেন সেটা অনন্তকালের কথা বলে, চিরকালের কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন হয়ে উঠলেন তো এমনই বহু বিষয় মিলিয়ে।

তারপরে আরেকটু বড় হয়ে, নবম শ্রেণিতে পড়লাম আরেকটি কবিতা, ‘সামান্য ক্ষতি'। তবে তাঁর যে লেখাটি আমাকে সবথেকে বেশি আবেগাক্রান্ত করল, সেটি ছিল 'পোস্টমাস্টার', নবম শ্রেণিতেই পড়ি। এই গল্প আমি এখনও পড়লে চোখে জল আসে, এত হৃদয়স্পর্শী গল্প! সত্যজিতের সিনেমাটিও আমি দেখেছি। গল্পটি বহুবার পড়েছি। সব মিলিয়ে বাঙালির হৃদয়কে ছুঁয়ে দেওয়া বলতে যা বোঝায়, গ্রাম্য অনাথ মেয়ে রতন, তাঁর সঙ্গে একজন পোস্টমাস্টারের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, চলে যাওয়ার সময় যে নদীর বর্ণনা, সব মিলে এই গল্প পড়লে তার ভেতর থেকে বেরনো যায় না। রতনের বেদনা তোমাকে তাড়া করবে। এই হচ্ছেন পাঠ্যবইয়ের রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া আরেকটি ঘটনা আমার জীবনে ঘটল। সেটাও ওই ১৯৬৮-৬৯ নাগাদ। রবীন্দ্রনাথের একটা গান শুনলাম, 'মায়াবন বিহারিনী হরিণী'। এই গানটা একটু জটিল, শব্দও ভারী। আমার এক মামা বললেন, এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ যে গান লেখেন, সেটা সেই প্রথম জানলাম। তারপর থেকে তো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে। রবীন্দ্রনাথই ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম। আমি মনে করি প্রতি বাঙালির শ্বাস-প্রশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন। রবীন্দ্রনাথ আকাশের মতো। আকাশ যেমন মাথার উপরে থাকে, রবীন্দ্রনাথও তেমন। এবং আকাশ কিন্তু পুরনো হয় না। আকাশ প্রতিদিন নতুন। রবীন্দ্রনাথকে আমি এভাবেই ভাবি।

গৌতম- তোমার কথার রেশ ধরে মনে পড়ছে, 'পথে প্রবাসে'-তে অন্নদাশঙ্কর লিখছেন, প্রকৃতি ঠাকরুণের কথা। এই বুড়ি ঠাকুমাকে প্রতিদিনই মনে হয় একজন নববধূ। তোমার এই রবীন্দ্রবীক্ষা আমাকে প্রকৃতি ঠাকরুণ মনে করাল। তুমি রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে দেখো এখন?

মিলন- তাঁর একটি কবিতা আছে খেয়া কাব্যগ্রন্থে। "দিনের শেষে, ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া, ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ... ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়"। পঙ্কজ মল্লিক রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাতে সুর দেন। সুর করে রবীন্দ্রনাথকে শোনান। রবীন্দ্রনাথ সেই সুরের প্রশংসা করেন। পরে পঙ্কজ কুমার গাইলেন কিন্তু গানটি জনপ্রিয় করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। অবিস্মরণীয় একটি গান। কিন্তু এই গান বা কবিতা, যাই বলি না কেন, এর যে কয়েকটি জায়গা আমার ভালো লেগেছিল সেখানে একটি লাইন ছিল, “ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়"। এর আগে আমরা লক্ষ্য করেছি, "ওই মেয়েটির ঠোঁট গোলাপ পাপড়ির মতো" অর্থাৎ একটি জিনিসের সঙ্গে অন্য জিনিসের তুলনা করা হচ্ছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রথম ছায়াকে ছায়ার সঙ্গেই তুলনা করলেন। ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়। আমি একজন লেখক হিসেবে এই বিষয়গুলিকে খুব খেয়াল করি।

গৌতম- রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্প নির্মাণটা তোমার কাছে...

মিলন- আরেকটা উদাহরণ দিই। 'ঘোমটা পরা ওই ছায়া'। কবিতাটি তো মৃত্যুচিন্তার কবিতা, "ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়"। মৃত্যুচিন্তার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের যে উপমা ব্যবহার, চিত্রকল্পের ব্যবহার- তুমি তা চোখের সামনে দেখতে পাবে। 'আঁধার ঘনাইছে বনে বনে', চোখের সামনে দেখতে পাবে। 'এই তো ভালো লেগেছিল, আলোর নাচন পাতায় পাতায়', তুমি চোখে দেখতে পাবে। এই হচ্ছে মহাকবি বা চিরকালীন কবির লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের একটি কম পঠিত কবিতা আছে। কবিতাটির নাম কুয়োর ধারে। সেই কবিতাটির মধ্যে একটা গল্প আছে। গল্পটা হচ্ছে, একজন পথিক একটা গ্রামের কুয়োর ধারে আসছে। সেখানে গ্রামের মেয়েরা জল নিতে এসছে। তো সেই পথিক এসে মেয়েদের কাছে অঞ্জলি পেতেছে, জল চাইছে একটু। সে পিপাসার্ত। একটি মেয়ে জল ঢেলে দেয়। তারপর পথিক চলেও যায়। কিন্তু ওই মেয়েটি আর পথিকটিকে ভুলতে পারে না। কুয়োর ধারে একটা নিমের গাছ ছিল। কবিতার লাইনগুলো খানিক এমনি, কুয়োর ধারে দুপুরবেলা তেমনি ডাকে পাখি, তেমনি কাঁপে নিমের পাতা আমি বসেই থাকি। 'বসে থাকি' না কিন্তু, ‘বসেই থাকি'।

গৌতম- একটা হ্রস্ব-ই আছে।

মিলন- এই 'বসেই', হ্রস্বই কেন? বসে থাকা একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার আর বসেই থাকা অনন্ত, চিরকালীন। এই মেয়েটি চিরকাল ওই মানুষটির জন্য অপেক্ষা করবে।

গৌতম- রামকাহিনিতে শবরীর যে প্রতীক্ষা...

মিলন- এই কবিতাটি আমি পড়ে অনেকবার ভেবেছি, কেন বসেই থাকি লিখলেন। যদি বসেই থাকি কথাটি না থাকত তাহলে কবিতাটি সামান্য এক তাৎক্ষণিক কবিতা। বসেই থাকি লেখার ফলে তা চিরকালীন হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথকে আমি এভাবে ভাবি।

আরও পড়ুন- কীভাবে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে তৈরি হলো গোটা রামায়ণ, কথাবার্তায় স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত

গৌতম- তুমি নিজে গদ্যসাহিত্যের একজন রূপকথার স্রষ্টা। বাংলা ছোটগল্পে একদম মুখের ভাষা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দশ বছরের যে পরীক্ষানিরীক্ষা সেটায় যেন সমস্ত সমকালকে তিনি অতিক্রম করে যাচ্ছেন। বলা যেতে পারে, আমরা যারা এখনও ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করি বা পড়ি, আমরা সবাই যেন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সেই ধারাটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি? গদ্য আরও আধুনিক হয়েছে পরে, তারাশঙ্কর, সমরেশ বসু, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁদের মতো করে আধুনিক করেছেন, তুমি তোমার মতো করেছো। কিন্তু তোমার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারই তোমরা বইছো?

মিলন- অবশ্যই, অবশ্যই। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি রবীন্দ্রনাথ মাথার উপরে। শিল্প সংস্কৃতির কোন জায়গাটা আছে যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই? বাংলা কবিতা লিখবে, উপন্যাস লিখবে, গল্প লিখবে, গান লিখবে কেউ আর সেখানে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা তো হয় না। রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম আধুনিক ছোটগল্প লিখেছেন। তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি ছোটগল্পের যে ব্যাকরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন, ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, শেষ হয়েও হইল না শেষ ইত্যাদি, ছোটগল্প সেখান থেকে অনেক সরে এসেছে। তাই তো নিয়ম। সাহিত্য বদলাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগোবে। সাহিত্যের ধারা বদলেছে কিন্তু পথ তৈরি করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই পথে হেঁটেই আমরা এগোচ্ছি।

গৌতম- বাংলা ছোটগল্পের আধুনিকতার জনক রবীন্দ্রনাথকে বলা যেতে পারে।

মিলন- এতে কোনও সন্দেহই নেই।

গৌতম- গানের প্রসঙ্গে আসি। রবীন্দ্রনাথ বারেবারে বলেছেন তাঁর গানটাই থেকে যাবে। বলেছেন, আমার গানকে যেন আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন দুই বাংলাতেই কথাগুলিকে এক রেখে, সুরগুলিকে নিজের মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে। তোমার কেমন লাগে?

মিলন- আমার খুব প্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, জর্জ বিশ্বাস। তাঁর একটি বই আছে, ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত। তাঁর আত্মজীবনী, ১৯৬৭ সালে সম্ভবত তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া থেকে...

গৌতম- না আমি সহমত নই। ওঁর একটা বা দুটো গানে কিছু যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার...

মিলন- আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি।

গৌতম- ‘ব্যান' করা হয়নি তাঁকে।

মিলন- কিন্তু তাঁর যন্ত্র ব্যবহারের জন্য কোনও কোনও গান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

গৌতম- তাঁকে রিটেক করতে বলা হয়েছিল, তিনি করেননি। সেটা তাঁর মান অভিমানের বিষয়।

মিলন- সেই সময় একজন মানুষ বেশি যন্ত্র ব্যবহার করতে চেয়েছেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন...

গৌতম- ওটা তো আমার সেই সন্তোষ কুমার ঘোষের সম্পাদকীয় শিরোনামের কথা মনে করায়, শিল্পী বনাম স্রষ্টা।

মিলন- কপিরাইট উঠে গেছে এখন। ফলে, এখন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে স্বেচ্ছাচারিতাও হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, যারা নতুন আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের গানকে গাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা কোনও না কোনওভাবে মানুষের কাছে তো সেই রবীন্দ্রনাথকেই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবার বলেছিলেন তাঁর গান যেন তাঁর গায়কির ঢঙে গাওয়া হয়। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে হয়তো সেটা করা উচিত। পাশাপাশি অনেক শিল্পীই আছেন যারা রবীন্দ্রনাথের গানকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। ওই স্বরলিপির মধ্যে থেকেই তারা কাজটা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অদিতি মহসিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, পশ্চিমবাংলার জয়তী চক্রবর্তী ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে বসে আছেন।

More Articles